সর্বশেষ

বন্যা আরও ভয়াবহ হবে, ডুববে উত্তরাঞ্চলও

প্রকাশ :


/ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও দুধকুমারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে চরাঞ্চলের প্রায় সহস্রাধিক পরিবার /

২৪খবর বিডি: 'জুনে একটি বড় বন্যা হবে- এমন আশঙ্কা গত মাসেই ছিল। সেই আশঙ্কা সত্যি হলো মাসের মাঝামাঝিতে। উজান থেকে আসা পানির ঢল আর বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ফুঁসে উঠেছে নদনদী। বানের জলে ভেসে গেছে সিলেট অঞ্চলের ৮০ ভাগ এলাকা। আর সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে। যা দেশের আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। দ্রুত বাড়ছে যমুনা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি। এ কারণে ডুবতে পারে উত্তরাঞ্চলও। রাজধানীর চারপাশের জেলাগুলোতেও ভারি বৃষ্টিতে বেড়েছে পানি। বন্যা ও পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট বিভাগের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও উত্তরাঞ্চলে পানি সহজে নামবে না।'

-তবে বন্যা মোকাবিলায় সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো এখন পর্যন্ত প্রস্তুতি শেষ করতে পারেনি। অবশ্য গতকাল শুক্রবার রাত পৌনে ৮টায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বন্যার্ত মানুষের জন্য ২৬ হাজার শুকনা ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় পর্যাপ্ত ত্রাণ যাচ্ছে না, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মিলছে না খাদ্যসামগ্রী ও বিশুদ্ধ পানি। স্বল্পতা রয়েছে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, টিউবওয়েল ও শৌচাগারের। সর্বোপরি কাজের ক্ষেত্রে এক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরেক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় নেই।

'দুর্যোগ, খাদ্য, কৃষি, স্বাস্থ্য ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবারের বন্যার ভয়াবহতা আগের বন্যাগুলোকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রস্তুতি নেওয়া হলেও তা যথেষ্ট নয়। অবশ্য বন্যাদুর্গত সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় উদ্ধার ও ত্রাণকাজে সেনা সদস্যদের মাঠে নামানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, বন্যায় আক্রান্ত এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণ ও ওষুধের মজুত রাখতে হবে।'

-সিলেটে বন্যা আরও ভয়াবহ হতে পারে, উত্তরেও চোখ রাঙাচ্ছে তিস্তা: গত তিন দিনে বাংলাদেশের উজানে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ওই বৃষ্টির পানি ঢল হয়ে বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সব কটি জেলায় প্রবেশ করেছে। সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাস বলছে, আগামী তিন দিন উজানে ভারতীয় অংশে ও বাংলাদেশ অংশে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

-অন্যদিকে, দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান নদী তিস্তা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি দ্রুত বাড়ছে। এরই মধ্যে তিস্তা অববাহিকার চারটি জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, রংপুরে বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে পারে বলে মনে করছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।। ব্রহ্মপুত্রের পানি যমুনা দিয়ে নামার সময় তিন-চার দিনের মধ্যে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল পর্যন্ত বন্যার পানি চলে আসতে পারে।

'বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, সিলেট বিভাগে গত কয়েক যুগের মধ্যে সবচেয়ে বড় বন্যা শুরু হয়েছে। দু-তিন দিন এই বৃষ্টি ও বন্যা চলতে পারে। ফলে ওই এলাকার মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় সরকারের সব বাহিনী ও সংস্থাকে সক্রিয় করতে হবে।'

-এদিকে ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর (আইএমডি) বলেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটির চেরাপুঞ্জিতে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা জুন মাসে ১২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত তিন দিনে সেখানে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এটিও গত ২৭ বছরের মধ্যে তিন দিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। চেরাপুঞ্জিতে আগামী ২৪ ঘণ্টায় আরও ৫৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে, ব্রহ্মপুত্রের উজানে আসামের গৌহাটিতে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। এ দুই এলাকার ভাটি হিসেবে বাংলাদেশের সিলেট ও কুড়িগ্রামে ওই পানি নামা শুরু করবে। এর আগে থেকেই ওই এলাকায় এমনিতেও বৃষ্টি বেশি ছিল। এর সঙ্গে নতুন পানি যোগ হয়ে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

'এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের হিসেবে, গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে সিলেট বিভাগের সব নদনদীর পানি ও উত্তরাঞ্চলে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। দেশের বিভিন্ন নদনদীর ১০৬টি পয়েন্টের মধ্যে ৮৬টির পানি বাড়ছে, ২০টির কমছে।'

-বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, দেশের একটি বিভাগের প্রায় ৮০ শতাংশ ডুবে যাওয়ার মতো বন্যা এর আগে বাংলাদেশে হয়নি। সিলেট বিভাগের বন্যা পরিস্থিতি আরও দু-তিন দিন অবনতি হতে পারে। উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতিও দ্রুত খারাপ হতে পারে। কারণ, উজানে ভারি বৃষ্টি শুরু হয়েছে, বাংলাদেশের ভেতরেও বৃষ্টি চলছে।

'পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফা উদ দৌলা বলেন, উজানের ঢলের কারণে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। আমরা ব্যারাজ এলাকাসহ আশপাশ মনিটর করছি।'

-কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোস্তফা কামাল বলেন, আগামী তিন দিন সিলেট বিভাগে বন্যা পরিস্থিতির আরও চরম অবনতি হতে পারে বলে বিশ্বের প্রধান প্রধান আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলগুলো নির্দেশ করছে। যুক্তরাজ্যের মডেল অনুসারে প্রায় ১১০০ মিলিমিটার বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী তিন দিনে ভারতের আসাম রাজ্যের ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় ৪০০ থেকে ৬০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। ফলে আগামীকাল রোববারের মধ্যে তিস্তা ও যমুনা নদীতীরবর্তী জেলাগুলোতে বন্যা শুরু হতে পারে। জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহভিত্তিক বন্যা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, সিলেট বিভাগের ৮০ শতাংশের বেশি স্থলভাগ পানির নিচে রয়েছে। এ গবেষক বলেন, এবার বঙ্গোপসাগর বেশি উত্তপ্ত থাকায় মেঘ ও মৌসুমি বায়ু বেশ শক্তিশালী ছিল। যে কারণে বৃষ্টি বেশি হচ্ছে। ফলে এবারের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের নদীগুলোকে দ্রুত খনন করে এর পানি ধারণের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। নয়তো প্রতি বছর এ ধরনের বন্যার মুখে পড়তে হবে।

বন্যা আরও ভয়াবহ হবে, ডুববে উত্তরাঞ্চলও

'সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, মানুষের জন্য ত্রাণ ও অন্যান্য উপকরণ সহায়তা দ্রুত দিতে হবে। একই সঙ্গে সঠিক পরিকল্পনা করে পুনর্বাসনের কাজ দ্রুত শুরু করতে হবে।'

* দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতি: বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ২৬ হাজার শুকনা ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। গতকাল রাতে মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, প্রতিটি প্যাকেটে চাল, ডাল, তেল, লবণ, চিনিসহ যে খাদ্যসামগ্রী রয়েছে তা পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারের এক সপ্তাহ চলবে। একই সঙ্গে নগদ টাকা এবং চালও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

* রাজধানীর আশপাশের জেলাও শঙ্কামুক্ত নয়: রাজধানীতে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ৩২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এরপর থেমে থেমে বৃষ্টি ঝরেছে রাতভর। রাজধানীর কাছের জেলা টাঙ্গাইলে ধলেশ্বরী ও মানিকগঞ্জের কালীগঙ্গা নদীর পানি বেড়েছে। বেড়েছে শীতলক্ষ্যার পানিও। এ কারণে রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলো শঙ্কামুক্ত নয়।

* সিলেট ও সুনামগঞ্জকে 'জাতীয় দুর্যোগপূর্ণ' এলাকা ঘোষণার দাবি: ভয়াবহ বন্যায় নিজেদের পরিবারের দুরবস্থার কথা তুলে ধরে সিলেট ও সুনামগঞ্জকে 'জাতীয় দুর্যোগপূর্ণ' এলাকা ঘোষণা এবং দ্রুত ত্রাণ সহায়তা প্রদানের দাবি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেট বিভাগের একদল শিক্ষার্থী। গতকাল বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে জালালাবাদ ছাত্রকল্যাণ সমিতি আয়োজিত মানববন্ধন থেকে তাঁরা এ দাবি জানান।

 

Share

আরো খবর


সর্বাধিক পঠিত